রাজু আনোয়ার: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। এরই অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত কুমারীপূজা। কুমারী পূজা শারদীয় দুর্গাপূজার এক বর্ণাঢ্য পর্ব। বালিকা প্রতিমায় মহামায়ার পূজা ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনার ফলিতরূপ এটি।
প্রকৃতপক্ষে এটি কুমারীর পূজা নয়। কুমারীতে পূজা। কুমারীতে ভগবতীর পূজা। একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানব বন্দনা, আর নারীর মর্যাদা এসবের সমন্বয়ে কুমারী পূজা। নারীর সম্মান, মানুষের জয়গান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজার অন্তর্নিহিত শিক্ষা।
শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে । গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
কুমারী হলো দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি। সাধারণত অষ্টমীর দিন করা হয় কুমারী পূজা। সব নারীর মধ্যেই আছে দেবী দুর্গার শক্তি। তাই নারী পূজনীয় -এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কুমারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। এ যেন কুমারীরূপে বিশ্বের নারীশক্তি, বিশ্বমাতৃশক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।
কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়।এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। কুমারী মেয়েকে মনে করা হয় সর্ববিদ্যাস্বরূপিণী। কুমারী পূজা ব্যতীত দেবতার পূজা, হোম ইত্যাদি কোনো কিছুই সফল হয় না। ভক্তদের বিশ্বাস, এর দ্বারা কোটি গুণ ফললাভ হয়,সকল বিপদ দূরীভূত হয়;কুমারীভোজনে ত্রিলোকভোজনের ফল হয়।
দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গয়না ও নানাবিধ অলঙ্কারে তাকে সাজানো হয়।পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল। কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়।
প্রতিমায় দেবীর পূজাতে আংশিক ফল হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায়। যাগ-যজ্ঞ-হোম সবই কুমারীপূজা ছাড়া সম্পূর্ণ ফলদায়ী নয়। কুমারীপূজায় দৈব-ফল কোটিগুণ লাভ হয়। কুমারী পুষ্প দ্বারা পূজিতা হলে তার ফল পর্বতসমান। যিনি কুমারীকে ভোজন করান তার দ্বারা ত্রিলোকেরই তৃপ্তি হয়। দেবী পুরাণ মতে, দেবীর পূজার পর উপযুক্ত উপাচারে কুমারীদের ভোজনে তৃপ্ত করাতে হবে, তবেই জগতের কল্যাণ হবে।
তন্ত্র অনুসারে এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা যায়। এক এক বয়সের কুমারীর এক এক নাম রয়েছে। এক বছর বয়সী কন্যার নাম- সন্ধ্যা, এভাবে দুই বছরের কন্যার নাম- সরস্বতী, তিন বছর- ত্রিধামূর্তি, চার বছর- কালিকা, পাঁচ বছর- সুভগা, ছয় বছর- উমা, সাত বছর- মালিনী, আট বছর- কুব্জিকা, নয় বছর- কালসন্দর্ভা, দশ বছর-অপরাজিতা, এগার বছর- রুদ্রাণী, বার বছর- ভৈরবী, তের বছর- মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছর- পীঠনায়িকা, পনের বছরের কন্যার নাম- ক্ষেত্রজ্ঞা, আর ষোল বছরের কন্যার নাম- অম্বিকা। দৈবী সম্পদের অধিকারিনী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণে বিধান আছে।
কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তি রূপ ধারণ করে। তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা।
কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি- পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি -সকল কল্যাণী শক্তির শ্রদ্ধার্ঘ্যই কুমারী পূজা। এ হলো সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা।
এদেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট, হবিগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলাশহরে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার প্রচলন আছে। প্রতিবছর দুর্গাদেবীর মহাষ্টমী পূজাশেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের কুমারী পূজা খুবই আকর্ষণীয়।
আলোআভানিউজ২৪ডটকম/আরএ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়