শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০

Aloava News24 | আলোআভা নিউজ ২৪

কবিগান যুগে যুগে

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৫ অক্টোবর ২০১৮

আপডেট: ০৬:৫২, ১৫ অক্টোবর ২০১৮

কবিগান যুগে যুগে

রাজু আনোয়ার: বাঙালী সংস্কৃতির একটি মৌলিক উদ্ভাবন কবিগান। দুটি দলের মধ্যে সংঘটিত বির্তক ও প্রতিযোগিতামূলক এই গানের মধ্যে দিয়ে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, কবিতা প্রতিভা ও সঙ্গীত  সাধনার এত  সুন্দর  সমন্বয় আর কোন সঙ্গীতে দেখা যায় না। আশ্বিন থেকে বৈশাখ মাস পযর্ন্ত বাংলার বিভিন্ন ধরনের বারোয়ারি পূজা ,মেলা ও অনুষ্ঠানে কবিগানের আসরের আয়োজন  হয়ে থাকে। সামিয়ানা টাঙ্গানো বিরাট প্যান্ডেলের মাঝখানে কাঠের মঞ্চ দিয়ে কবিগানের আসর তৈরি করা হয়। কখনো উন্মুক্ত জায়গায়, কখনো শ্মশানখোলায়, কখনো বড় গাছের নিচে, কখনো বাড়ির আঙ্গিনায়, কখনো বারোয়ারি মন্দিরের সামনে, কখনো খেলার মাঠে, কখনো মেলার মাঠে, আবার কখনো অডিটোরিয়ামে এ আসরের মঞ্চ তৈরি হয়। চতুষ্কোণ এই মঞ্চের একদিকে একটি দল এবং অন্যদিকে প্রতিপক্ষ দলের সদস্যগন আসন গ্রহন করেন। প্রথমে একটি দল আসরে দাঁড়িয়ে আসর বন্দনা রূপে পূর্বরচিত একটি ‘ ডাক’ বা সমজাতীয় গান দিয়ে কবিগানের সূচনা করে। এ সময়ে একাধিক দোহার আসরে দাঁড়ান এবং তারা কমপক্ষে একবার করে প্রত্যেকে প্রতিটি কলি গেয়ে থাকেন। ডাক গান পরিবেশন শেষে একই নিয়মে একটি মালশি গান পরিবেশন করা হয়। এই গান গুলো ডাক গানের চেয়ে দীর্ঘতর হয়। মালশি গান পরিবেশনের সময়ে কবিয়াল দোহারদের পেছনে দাঁড়িয়ে গানের কলি বলে দেন। প্রথম দলের ডাক গান ও মালশি গান গাওয়া শেষ হওয়ার পরে দ্বিতীয় দল আসরে আসে এবং একইভাবে প্রথমে একটি ডাক গান এবং পরে একটি মালশি গান পরিবেশন করে। এরপরই শুরু হয় কবিগানের প্রতিযোগিতার মূল পর্ব। প্রথম দলের কবিয়াল প্রথমে দোহারদের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক সখীসংবাদ পর্যায়ের একটি চাপান গান পরিবেশন করেন। এই গানের কথা এমনভাবে উপস্থাপিত হয়, যাতে রাধা বা কৃষ্ণ সখীদের প্রতি অথবা সখীরা রাধা বা কৃষ্ণের প্রতি অভিযোগ বা প্রশ্ন করে। দ্বিতীয় দলের কবিয়ালকে এইসব অভিযোগ বা প্রশ্নের জবাব দিয়ে গান রচনা করে পরের আসরে পরিবেশন করতে হয়। দ্বিতীয় কবিয়াল সখীসংবাদের জবাব পরিবেশনের পরে প্রথম কবিয়ালের উদ্দেশ্যে আর একটি চাপান গান পরিবেশন করে থাকেন। দ্বিতীয়  পর্যায়ের এই চাপান গানের নাম ‘কবি’ বা ‘লহর কবি’। পরবর্তী আসরে প্রথম কবিয়ালকে এই গানের জবাবে গান পরিবেশন করতে হয়। ‘সখীসংবাদ’ ও ‘কবি’  নামক গান পরিবেশনের পর শুরু হয় কবির টপ্পা ও পাঁচালি পর্ব। প্রথম কবিয়াল ‘ কবি’ গানের জবাব গান শেষ করার পরপরই একটি টপ্পা গান পরিবেশন করেন। এই টপ্পা গানের মাধ্যমে কবিয়াল কোনো একটি চরিত্রে নিজেকে এবং দ্বিতীয় কবিয়ালকে তার বিপরীতধর্মী একটি চরিত্রে আরোপ করান। টপ্পা গানের শেষ অংশে থাকে দ্বিতীয় কবিয়ালের প্রতি এক বা একাধিক প্রশ্ন। টপ্পা গাওয়া শেষে দোহারগন আসরে বসে পড়েন। প্রথম কবিয়াল তখন একা দাঁড়িয়ে প্রথমে একটু ধুয়া গান পরিবেশন করেন। পরে ধুয়ার সুরে বা ধুয়া গানের চিতানের সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ছড়ার আকারে প্রথমে আসর- বন্দনা করেন এবং পরে টপ্পায় উপস্থাপিত বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এই জাতীয় ছড়াকাটার নাম পাঁচালি। পাঁচালির মধ্যে আরো এক বা একাধিক ধুয়া গান গেয়ে ছড়ার ছন্দের পরিবর্তন করে উপস্থাপনার সুরে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করা হয়। প্রথম কবিয়ালের আসর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কবিয়াল আসরে দাঁড়িয়ে একইভাবে টপ্পা পরিবেশন করেন। টপ্পা শেষে তিনি ও পূর্ববর্তী কবিয়ালের মতো একটি ধুয়া গান গেয়ে পাঁচালির মধ্যে প্রবেশ করেন। পাঁচালির মাধ্যমেই তিনি পূর্ববর্তী কবিয়ালের প্রশ্নের জবাব দেন, ভিন্নমত ব্যক্ত করেন, নতুন বিতর্কের অবতারণা করেন, কখনো আবার নতুন প্রশ্নের মাধ্যমে প্রথম কবিয়ালকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় বা তৃর্তীয় বারের আসরে পুনরায় কোন টপ্পার দরকার হয় না। কবিয়ালদ্বয় আসরে এসেই ধুয়া গানের সুরে পাঁচালি চালিয়ে যেতে থাকেন। কবিয়ালদের এই আসা - যাওয়ার এক পর্যায়ে যখন গান শেষ করার তাগিদ আসে, তখন যে কবিয়াল আসরে থাকেন তাকেই জোটের পাল্লা নামক অন্ত্য ভাগের সূচনা করতে হয়। সাধারনত একটি ধুয়া বা ধুয়া গান দিয়ে জোটের পাল্লা অংশ সূচিত হয়ে থাকে। ধুয়ার কলি বা কোনো ধুয়া গানের একটি চিতান (স্থায়ী), গাওয়া শেষ হতে না হতেই উভয় কবিয়াল আসরে দাঁড়িয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হন। এক্ষেত্রে প্রথম জন নির্দিষ্ট সুর-তালের পাঁচালির মাধ্যমে দ্বিতীয় সরকারকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, দ্বিতীয় জন একইভাবে প্রথম জনের প্রশ্নের জবাব দেন বা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। এই পর্যায়ে প্রশ্নোত্তর ও ছড়াকাটার লয় ক্রমে দ্রুততর হতে থাকে এবং অবশেষে কবিগানের সমাপ্তি ঘটে। কবিগানে দলের দলপতিকে বলা হয় ‘সরকার’। দলের সঙ্গীত-সহযোগীদের নাম দোহার। যন্ত্রসঙ্গতকারীদের মধ্যে টুলি প্রধান। অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গতকারীদের মধ্যে রয়েছে কাঁসিবাদক, বাঁশিবাদক, বেহালাবাদক, দোতারাবাদক, হারমোনিয়ম বাদক প্রমুখ। কমবেশি দশজন সদস্য নিয়ে এক একটি দল গঠিত হয়। কবিগানের সুর মিশ্র সুর। এর মধ্যে কীর্তনের সুর রয়েছে, রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত, বাউল-ভাটিয়ালি প্রভৃতি গানের সুর। কবিগানের অন্যতম রূপকার কবিয়াল রমেশচন্দ্র শীল। তবে এদেশের কবি গানে বিজয় সরকারের অবদানও অসামান্য। কবিগানের পাঁচালিতে বিভিন্ন আঙ্গিকের ধুয়া গান পরিবেশনে তার জুড়ি নেই। আলোআভানিউজ২৪ডটকম/আরএ
শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়