রাজু আনোয়ার: মোহনীয় -মিষ্টি-মধুর সুরেলা কন্ঠ নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি। যার কন্ঠজাদুতে মুগ্ধ হতেন ছোট থেকে বড় সকল বয়সী শ্রোতা। অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সফলতা পেলেও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে অনেক মজবুত আসনে অধিষ্ঠিত রয়েছেন তিনি আজও । হ্যাঁ, কিশেোর কুমারের কথাই বলছি। ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক গায়ক কিশোর কুমারের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । ১৯৮৭ সালের আজকের দিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন কীর্তিমান এই সঙ্গীত প্রতিভা।
উপমহাদেশের সঙ্গীতের ঈর্ষণীয় প্রতিভা কিশোর কুমারের জন্ম ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়াতে এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। ছোটবেলায় নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। চার ভাই-বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কিশোরের শৈশবকালীন সময়েই তার বড়দা অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতাই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ছোট্ট কিশোরের উপরে । ছোটবেলা থেকেই কিশোর বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের গানগুলো নকল করে গাইতেন। শচীন দেব বর্মণের পরামর্শে কিশোর একসময় নিজের গাইবার কায়দা পাল্টিয়ে এমন এক কায়দা উদ্ভাবন করেন যা সেই সময়ের অপর প্রধান দুই গায়ক মহম্মদ রফি এবং মুকেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।শচীন দেব বর্মণ ছাড়াও খেমচাঁদ প্রকাশের সুর জিদ্দি সিনেমার গান গেয়ে কিশোর গায়ক হিসাবে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। তার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গলাকে ভেঙে গান গাওয়া যা আগে কখনো শোনা যায়নি। তবে এই কায়দা খুবই জনপ্রিয় হয়।
দাদা অশোক কুমারের ফিল্ম জগতে অনেক পরিচিতি থাকার ফলে কিশোর বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান। তবে তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। এই সিনেমাগুলোয় তিনি গান গাইবারও সুযোগ পেতেন। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত কমেডি নায়ক হিসাবে জনপ্রিয় হন। ভারতীয় বাঙালি গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, স্ক্রিপ্ট লেখক, চিত্রনাট্য লেখক এবং রেকর্ড প্রযোজক ছিলেন তিনি। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারে।
১৯৬৯ সালে রাজেশ খান্না অভিনীত শক্তি সামন্ত’র আরাধনা শুভমুক্তি পায়। ছবিতে কিশোর কুমারের গাওয়া তিনটি গান খুবই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সিনেমায় রূপ তেরা মস্তানা গানের জন্য কিশোর প্রথমবার ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান।
পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন- রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীব কুমার এবং দেব আনন্দের গলায় তিনি গান করেন। এই সময়ে শচীন দেব বর্মণ এবং রাহুল দেব বর্মণের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল এবং কিশোর জুটির কিছু অনবদ্য সিনেমার নাম হলো- শোলে, ওয়ারান্ট, হীরা পান্না, শরীফ বদমাশ, আঁধি, রকি, দ্য বার্নিং ট্রেন, আপকি কসম, আপনা দেশ, ধরম করম, টক্কর, সীতা আউর গীতা, জোশিলা, কসমে ভাদে, রামপুর কা লক্ষ্মণ, কালিয়া, গোলমাল প্রভৃতি। সুরকার রাজেশ রোশন এবং বাপ্পী লাহিড়ী’র সুরেও কিশোর বেশ কিছু হিট গান গেয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের কথায়, ‘কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোতাবেক দৃশ্যে মানিয়ে যায়।’
কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার তার পুরো কেরিয়ারে আটবার শ্রেষ্ঠ গায়কের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। হিন্দির পাশাপাশি তিনি প্রচুর জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা এবং বাংলা আধুনিক গানও গেয়েছেন। শেষদিকে এসে কিশোর কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের অ্যালবাম রেকর্ড করেন। কিশোর কুমার সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলেগু ভাষায়।
অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান শিল্পীর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন। বেঁচে থাকতে কিশোর কুমার তার স্ত্রী লিনা চান্দভারকারকে বলেছিলেন- ‘আমি যখন থাকব না তখন দেখো লোকে কেমন খুঁজছে আমায়! ঠিক তাই হলো! তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার গান এখনো গেঁথে আছে অগণিত ভক্ত-শ্রোতাদের হৃদয়ের গহীনে।
আলোআভানিউজ২৪ডটকম/আরএ
সর্বশেষ
জনপ্রিয়