সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না আলু

এক মাস আগের কথা।বাজারে ৩০ টাকায় পাওয়া যেতো আলু,মাস ঘুরতে না ঘুরতে সেই আলুর দাম এখন বেড়েছে দুই গুণ । রাজধানীসহ দেশের খুচরা বাজারগুলোতে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে।
খুচরার পাশাপাশি আলুর দাম বেড়েছে পাইকারী বাজারেও। তবে কয়েক ধাপে আলুর দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রয়েছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি খুচরায় বিক্রমপুর আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজিদরে আর রংপুর ও রাজশাহীর আলুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা কেজিদরে। ভর্তার আলুর (এক প্রকার ছোট ছোট আলু) এক কেজির দাম চাওয়া হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। আর কারওয়ানবাজার পাইকারী বাজারে (আড়তে) প্রতিকেজি বিক্রমপুর আলু (পাইকারী) বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা আর রংপুর ও রাজশাহীর আলুর বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা কেজিদরে।
আলুর দাম বাড়ার বিষয়ে পাইকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার মধ্যে ত্রাণ বিতরণে আলুর ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে এ কারণে আলুর মজুদ শেষ হয়ে আসছে। তাছাড়া আলুর উৎপাদন কম হওয়া, বন্যায় নতুন আলুর রোপণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়া। এছাড়া নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলুরও দাম বাড়ে সমান্তরালভাবে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলু পাইকার বাজার থেকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিতে চার ধাপে টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে রয়েছে মেতি (আঞ্চলিক ভাষা, কুলি) খরচ, বোর্ডভাড়া (আলু কেনার পর বাজারে যেখানে স্তুপ করা হয়) ও চাঁদা, পরিবহন ভাড়া ও দোকান ভাড়া। এই চার কারণে প্রতিকেজিতে প্রায় পাঁচ টাকা খরচ পড়ে বলেও জানান তারা।
আলুর দর বৃদ্ধি বিষয়ে কারওয়ানবাজারের একজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান,আলুর দাম বাড়ার পেছনেও কাজ করেছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। নিয়মিত বাজার মনিটরিং না হওয়া এবার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে আলু ।
এদিকে গত ১১ অক্টোবর (রোববার)দুপুরে সচিবালয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারার হাউড্রোলিক এলিভেটর ড্যামের ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন,করোনাকালে গরীবদেরকে বেশি ত্রাণ দেওয়ায় আলু ও চালের দাম বেড়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘কেনো বাড়লো আলু, চালসহ সবজির দাম? করোনাকালে ত্রাণ নিয়ে মানুষ গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করেছে’। এখন গরীব মানুষ নেই বললেই চলে, ত্রাণের চাল নিয়ে গবাদিপশুকে খাওয়াচ্ছে মানুষ।
একই সাথে মন্ত্রী স্বীকার করেন বাজারদর বৃদ্ধিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা কারসাজি করে। এদের দৌরাত্ম্য কমানো উচিত।
তবে কৃষি মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর আলুর দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সিন্ডিকেট আরও বেশি উৎসাহ পেয়েছেন বলে মনে করেন অনেকেই।
ইতিমধ্যে চালের মতো আলুর দামও বেঁধে দিয়েছে সরকার। তিন পর্যায়ে এই দাম নির্ধারণ করা হয়। কেজিপ্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা। এই দামে আলু বিক্রি না করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয় ।
গতকাল বুধবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশের সব জেলা প্রশাসককে এই ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, এই বছর এক কেজি আলু উৎপাদনের খরচ পড়েছে আট টাকা ৪০ পয়সা। আর আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন। সংস্থাটির হিসাবে দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৭৭ লাখ টন। আর বীজ আলু হিসাবে আরও ২০ টন আলুর প্রয়োজন হয়।
তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, চলতি বছর ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। তাদের হিমাগারগুলোতে বর্তমানে আলু রয়েছে ৪০ লাখ টন। এর মধ্যে ১৫ লাখ টন বীজ আলু। মাসে দেশে আলুর প্রয়োজন হয় ৮ লাখ টন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, কৃষকেরা এ বছর ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি ধরে আলু বিক্রি করেছে। কয়েক হাত ঘুরে হিমাগারে রাখার খরচসহ হিসাব কষলে তা কোনোভাবেই ২০ টাকার বেশি হয় না। তারপরেও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা কেজি ধরে আলু বিক্রি করতে বলা হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়েও যথেষ্ট যৌক্তিক মুনাফা ধরেই দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
তবে হিমাগার সমিতি থেকে বলা হয়েছে, চালকলগুলোতে রাখা চালের মালিক সংশ্লিষ্ট কলমালিকেরা। কিন্তু হিমাগারের রাখা আলুর মালিক অন্যরা, তাঁরা শুধু ভাড়া পান। ফলে হিমাগার মালিকেরা আলু বিক্রির ক্ষমতাই রাখেন না।
সরকার দাম নির্ধারন করে দিলেও বাজারে নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না আলু। এতে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাজার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।প্রায় এক মাস ধরে অস্থিরতা তৈরি করার পর গত দুই সপ্তাহে লামাগহীন হয়ে যায় পণ্যটির দাম।
অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে এখনও খুচরা বাজারে মানা হচ্ছে না সরকারের (কৃষি বিপণন অধিদফতর) নির্ধারিত আলুর দাম। এখনও বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিদরে।
এদিকে সরকারের নির্ধারিত দামকে ক্রেতাসাধারণ সাধুবাদ জানালেও বর্ধিত দাম রাখছেন না বিক্রেতা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতা। আর বিক্রেতা বলছেন, আগের বেশি দামে আলু কেনায় লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের। তবে বর্ধিত দামের আলু বাজারে এলে দাম কমে আসবে বলে জানান বিক্রেতারা।
বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ ও কৃষির সমসাময়িক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আলু ব্যাবসায়ীরা বর্তমানে প্রতিকেজি আলুতে অন্তত ২০ টাকা লাভ করছেন। এটা একেবারেই অনৈতিক। কেজিপ্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা বেঁধে দেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়ন কঠিন। তবে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ