সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা উৎসব

রাজু আনোয়ার: হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা । রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করে রথ চালানো হয় এ উৎসবের মধ্য দিয়ে । ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বিষ্ণুর রথাযাত্রা বর্ণিত হয়েছে ।
তবে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার সময়কালও বিভিন্ন; কোথাও বৈশাখ মাসে, কোথাও আষাঢ় মাসে, আবার কোথাও কার্তিক মাসে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠান হয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে, আর একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা ফিরতি রথ। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। একেই বলে উল্টা রথ।
রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া ভারতীয় রাজ্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির মাহেশ কলকাতা ও বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ রথ ইসকনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ।
রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রার সময় যাত্রাপালা মঞ্চস্থের রীতি বেশ জনপ্রিয়। রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ দেশের সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি সর্বসমক্ষে বের করা হয়। তার পর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনও কোনও জায়গায় একটি সুসজ্জিত সুবৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজার পরে রথ টানা হয়। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
পুরীতে বছরে এই এক দিনই অহিন্দু ও বিদেশিদের মন্দির চত্বরে এসে দেবদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। পুরীতে যে রথগুলি নির্মিত হয় তাদের উচ্চতা ৪৫ ফুট। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলে এই রথযাত্রা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে । প্রতি বছর চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এ রথাযাত্রা শুরু হয়। এর ৯ দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় উল্টো রথযাত্রা। এবারের উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ জুলাই।
রথযাত্রা একেক অঞ্চলে একেক নামে পরিচিত। শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার প্রচলন পুরী জগন্নাথ দেবের মন্দির থেকে। বাংলাদেশেও রথযাত্রা হিন্দুদের একটি পবিত্রতম ধর্মীয় উৎসব। ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ে এ রথযাত্রা যশোমাধবের রথযাত্রা নামে উপমহাদেশ বিখ্যাত। গাজীপুরের জয়দেবপুরে এই রথযাত্রা মাণিক্যমাধবের রথযাত্রা নামে পরিচিত।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, জগন্নাথ দেব হলেন জগতের নাথ বা অধীশ্বর। জগৎ হচ্ছে বিশ্ব আর নাথ হচ্ছেন ঈশ্বর। তাই জগন্নাথ হচ্ছেন জনগণের ঈশ্বর। তাঁর অনুগ্রহ পেলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। জীবরূপে তাঁকে আর জন্ম নিতে হয় না। এ বিশ্বাস থেকেই রথের ওপর জগন্নাথ দেবের প্রতিমূর্তি রেখে রথ নিয়ে যাত্রা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব উপলক্ষে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) ঢাকার নয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আজ থেকে শুরু হয়েছে । ইসকনের স্বামীবাগ আশ্রম বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ ও আলোচনা সভা শেষে দুপুর আড়াইটায় সেখান থেকে জগন্নাথ দেব, শুভদ্রা ও বলরামের প্রতিকৃতি নিয়ে বিশাল রথসহ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শুরু হয় । তিনটি সুবিশাল রথসহ এ শোভাযাত্রা নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে শেষ হয় ।
স্বামীবাগ আশ্রমে মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে রথযাত্রার উদ্বোধন করবেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এতে সভাপতিত্ব করেন যশোদা নন্দন আচার্য। ২২ জুলাই ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে স্বামীবাগ আশ্রম পর্যন্ত উল্টো রথযাত্রা ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসব অনুষ্ঠানমালা শেষ হবে। ধামরাইয়ে বিকেল ৩টায় ঐতিহ্যবাহী যশোমাধবের রথযাত্রা শুরু হয় ।
শুভ রথযাত্রা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
ঢাকায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) রথযাত্রা উপলক্ষে নয় দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে রয়েছে হরিনাম সংকীর্তন, বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলী কীর্তন, আরতি কীর্তন, ভাগবত কথা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ, ধর্মীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও ধর্মীয় নাটক মঞ্চায়ন।
বর্ণাঢ্য সাজে তিনটি বিশাল রথে জগন্নাথ দেব, শুভদ্রা ও বলরামের প্রতিকৃতিসহ শোভাযাত্রা বের করা হবে। শোভাযাত্রা জয়কালি মন্দির, মতিঝিল শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলার মোড়, বায়তুল মোকাররম, পুরান পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, রমনা কালিমন্দির, টিএসসি, জগন্নাথ হল ও পলাশী হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ