মঞ্চে নজরুলের নাটক

রাজু আনোয়ার: নাটকের ভাষা ও চরিত্র তখনি বদলে যায় যখন নাটকটি রচনা করেন কোনো একজন কবি। কবির হাতের নাটক কেবল বস্তুগত জীবনের ভাষাচিত্র নয় এটি জীবনের কাব্যরূপ হয়ে ওঠে । জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাটক জীবনের হুবহু অনুকরণ নয় বরং এটি কাব্যের অনুপম ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ জীবনের ব্যাখ্যা। বাংলা নাট্যের ভেতরের গীত সুধারসের ধারায় প্লাবিত হয়েছে নজরুলের নাটক ।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শুরুতে জীবিকার তাগিদে যোগ দিয়েছিলেন গ্রাম্য লেটো গানের দলে । লেটো গানে পালা রচনার মধ্যদিয়ে নজরুলের নাট্য প্রতিভার যাত্রা শুরু হয়েছে বলেই সুর ও কাব্য তাঁর লেখা নাট্য থেকে বিসর্জিত হয়নি ।
গীত ও নাটের যুগল বন্ধনে দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়েছে বাংলা নাটক । নজরুলের নাটকে তারই প্রতিফলন ঘটেছে । এই ধারার আধুনিক রূপায়ন ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । রবীন্দ্রনাথের মতোই সুর ও কাব্যময়তাকে বাঙালির শিল্পভাবনার উৎসের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন নজরুল । তাই বলা যায় বালক কবির হাতে রচিত লেটো গানের পালার আধুনিক রূপায়ণ ঘটেছে ‘সেতুবন্ধ’, ‘মধুমালা’ প্রভৃতি নাটকে ।
নজরুল তার ১২-১৩ বছর বয়সে বাঙালির সুরপ্রিয়তাকে মূল বিবেচনায় রেখে রচনা করেছিলেন দাতা কর্ণ, সুকণি বধ, চাষার সং, মেঘনাদ বধ, রাজপুত্র, আকবর বাদশা, কবি কালিদাস প্রভৃতি পালা। এই পালাগানগুলো বালক কবি আসরে সুর, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করতেন। নতুন নতুন নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবি তাঁর নাট্যভাবনাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন।
একেবারেই বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কবি যে রেকর্ড নাটিকাগুলো রচনা করেছিলেন,তাতেও সুরের মধ্যদিয়ে শ্রোতার সামনে বহু চিত্রকল্পের সমাহার ঘটিয়েছেন। আর এভাবে গাননির্ভর নাট্য রচনা কবি নজরুলের সমগ্র জীবনের বিচিত্র ভুবনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত একাঙ্কিকা ও রেকর্ড নাট্যের তালিকার মধ্যে রয়েছে ছিনিমিনি খেলা, খুকী ও কাঠ বেড়ালী, জুজুবুড়ির ভয়, পুতুলের বিয়ে, শ্রীমন্ত, আল্লাহর রহম, কালির কেষ্ট, কানামাছি ভোঁ ভোঁ ও বনের বেদে।
বাংলা সংস্কৃতির অনন্য স্রষ্টা কবি নজরুল ইসলাম । প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি তিনি । রণাঙ্গনে, রঙ্গালয়ে, কারাগারে, চলচ্চিত্রে, নাটকে, রেডিওতে, মঞ্চে, কবিতায় এমনকি সাংবাদিকতাসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সকল শাখায় তিনি অনন্য । যে বৈচিত্র্য এবং বিপুল রচনাসম্ভার নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছিলেন তার অনেক কিছুই আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে। বালক বয়সে কবি নজরুল ছিলেন লেটো দলের সর্দার। নাটক রচনার মাধ্যমেই মূলত তার বিস্ময়কর, সৃষ্টিশীল জীবনের অভিযাত্রা।
নজরুল মঞ্চনাটক, রেকর্ড নাটক, বেতার নাটক ও সিনেমায় যে বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভার সংযোজন করেছেন তা আজো অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত। তার রচিত নাটক-নাটিকা ও নাট্যধর্মী রচনার সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। বিচিত্র আঙ্গিক, বিচিত্র বিষয় নজরুল একাঙ্ক নাটক, পূর্ণাঙ্গ নাটক, কাব্যনাটক, শুধুমাত্র বাচ্চা মেয়েদের অভিনয় উপযোগী নাটক এমনকি রেডিওর জন্য অজস্র গীতিনাট্য লিখেছেন। বিশুদ্ধ রঙ্গ-কৌতুকের নাটকও লিখেছেন নজরুল।
সুস্থাবস্থায় নজরুলের তিনটি নাট্যগ্রন্থ ঝিলিমিলি, আলেয়া, পুতুলের বিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। অসুস্থ হওয়ার পর গ্রন্থাকারে বেরিয়েছিল মধুমালা। একটু লোককাহিনী, একটু রূপকথা, সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর একটি নাটক এটি । তিনি যেমন সম্পূর্ণ হিন্দিতে হিন্দুদের জন্য নাটক লিখেছেন ‘জন্মাষ্টমী’ নামে। আবার মুসলমানদের জন্যও ঈদ নিয়ে লিখেছেন ‘ঈদ’ নামের নাটক। নজরুল তার নিজের লেখা আলেয়া নাটকে দু’একবার অভিনয়ও করেছিলেন কোন একজনের অনুপস্থিতিতে।
নজরুল প্রথমদিকের বাংলা একাঙ্ক নাটক রচয়িতাদের একজন। নজরুলের একাঙ্ক নাটকগুলোতে আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটা ধারাবাহিকতা আছে। নজরুলের প্রথম দিকের একাঙ্ক নাটকগুলোর একটিতে রক্তকরবী’র ছায়া আছে, আরেকটিতে ডাকঘরের। ‘ভূতের ভয়’ বলে নজরুলের একাঙ্ক নাটক মূলত ইংরেজের বিরুদ্ধে। এখানে ভূত হচ্ছে ইংরেজ। ‘শিল্পী’ নামে একটা একাঙ্ক আছে নজরুলের। এখানে দুই নজরুলের কথা আছে। একজন মানুষ নজরুল, অন্যজন শিল্পী নজরুল। শিল্পীসত্তার যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং সমন্বয়— এটা নজরুল আশ্চর্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নাটকটিতে ।
মন্মথ রায়, কাজী নজরুল ইসলাম ও সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত— এঁরা তিন জন মিলে একটি ‘নাট্যত্রয়ী’ তৈরি হয়েছিল। নাট্য জগতে তিন জনই শীর্ষস্থানীয়। সচীন্দ্রনাথের ‘সিরাজউদদৌলা’ নাটকের গানগুলো নজরুলের লেখা। অন্যদিকে মন্মথ রায়েল ‘মহুয়া’ নাটকের জন্যও গান লিখলেন তিনি । মন্মথ রায়ের আরেকটি নাটক ‘কারাগার’। এই নাকটের গানও নজরুলের লেখা।
নজরুলের নাটকের ভাষা গীত ও কাব্যের যুগলবন্দীতে আবৃত। নজরুল বাংলা নাট্যরচনার ধারায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যের সঙ্গীতময়তাকে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতে পেরেছেন। তার নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে।
কবি নজরুল রচিত নাটকের সংখ্যা শতাধিক হলেও হাতেগোনা কয়েকটি নাটকই আমাদের কাছে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- আলেয়া, মধুমালা, বিদ্যাপতি, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর, শ্রীমন্ত, বিষ্ণুপ্রিয়া, বনের বেদে, ঝিলিমিলি, সেতু–বন্ধ, ভূতের ভয় ইত্যাদি। তবে তার নাটক নিয়ে টেলিভিশনে যতখানি কাজ হয়েছে, সে অর্থে মঞ্চরূপ নাটকের সংখ্যা একবারের নগণ্য।
বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে লেখা নজরুলের নাটক ঝিলিমিলি। বাস্তবজীবনের প্রেম ও বিরহকে কেন্দ্র করে এই নাটকটি লেখা হয়েছে। নজরুল যতই রোমান্টিক কিংবা বাস্তববুদ্ধি বিবর্জিত হোন না কেন ঝিলিমিলি নাটকের প্রেম পরাস্ত হয়েছে প্রখর বাস্তবতার কাছে।
নজরুলের আলোচিত আরেক নাটকের নাম আলেয়া। আলেয়া প্রায়শই গ্রাম্য জনপদের বিরান প্রান্তরে, বিলের ধারে হঠাৎ জ্বলতে দেখা যায়। জ্বলেই আবার হারিয়ে যায় আলেয়া। আলেয়ার মতো নরনারীর চিত্তেও হঠাৎ প্রেমের শিখা জ্বলে ওঠে এবং তা অনির্দেশ্য কোনো বেলাভূমিতে আবার হারিয়ে যায়।
নজরুলের মধুমালা দৃশ্য ও কাব্যের সংমিশ্রণে গঠিত বলে এটি সত্যিকার অর্থেই দৃশ্যকাব্য। গীত ও সংলাপের মধ্যদিয়ে এই নাটকের চরিত্রগুলো ক্রমাগত গঠিত হয়েছে। এ নাটকের মধ্যে দিয়ে রূপকথার আদলে থেকেই তিনি রূপকথাকে ভেঙেছেন।
যেসব নাটকের দল এখন পযর্ন্ত নজরুলের নাটক নিয়ে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে ১৯৮৮ সালে সিরাজউদ্দৌলা থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘রূপান্তর’ ও ‘অগ্নিগিরি’, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের নাট্যদল তির্যক মঞ্চে আনে নজরুলের কবিতা অবলম্বনে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, একই দল ৯৯-এ মঞ্চে আনে ‘মধুমালা’। ওই বছর ‘ভূতের ভয়’ মঞ্চে তোলে হবিগঞ্জের দল নাট্যমেলা। ২০০১ সালে প্রতিবিম্ব থিয়েটার আনে নজরুলের ‘ভিক্ষে দাও’।
২০০২-এ বি.বাড়িয়ার দল সাহিত্য একাডেমি মঞ্চাঙ্গনে আনে ‘রাক্ষুসী, একই সময়ে লোক নাট্যদল টিএসসি মঞ্চে আনে ‘ঝিলমিল’। ২০০৮ সালে ‘মধুমালা’ মঞ্চে আনে লোক নাট্যদল সিদ্ধেশ্বরী। এ ছাড়াও নজরুলের ‘মানুষ’ ও ‘রাক্ষুসী’ মঞ্চে তোলে চাঁদপুরের দল অনন্য নাট্যগোষ্ঠী, বগুড়া থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘দ্রোহ’, ।
কাজী নজরুল ইসলামের গীতিনাট্য ‘আলেয়া’ অবলম্বনে ২০১০ সালের ১৭ জুন প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনে নাটক ‘দ্রোহ প্রেম নারী’। রাজা মীনকেতু আর অন্য দেশের রানী জয়ন্তীকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘দ্রোহ প্রেম নারী’ কাহিনি। ২০১১ সালে ঢাকার দল জেনেসিস থিয়েটার মঞ্চে আনে নজরুলের জীবনীভিত্তিক নাটক ‘দামাল ছেলে নজরুল’।
নজরুলের ‘সাপুড়ে’ গল্প অবলম্বনে ২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘নীলাখ্যান’। এছাড়াও বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাদের মঞ্চে নজরুলের বেশকিছু শিশুকিশোর নাটক হয়েছিল। কিন্তু তা একেবারেই অপ্রতুল এবং হাতেগোনা কয়েকটি প্রদর্শনীর পর নিয়মিত হতে পারেনি। তবে নজরুলের নাটক নিয়ে অনেক নাট্যদলই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে এরই মধ্যে ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শিশু-কিশোর নাট্যান্দোলনের পথিকৃৎ নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘নজরুল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। ‘কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গানে যেমনি ছিল তার অসাধারণ শিল্পগভীরতা, তেমনি নাটকের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অতুলনীয়।
তিনি বলেন, টেলিভিশনে এবং শিশু-কিশোর নাটকে যতটা নজরুলচর্চা হয়েছে সে তুলনায় আমাদের মঞ্চে নজরুল অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের আরও আন্তরিক হওয়া জরুরী। না হলে আমাদের জাতীয় কবির প্রতি অশ্রদ্ধা-অমর্যাদাই করা হবে।
বাঙালির নিজস্ব নাট্যনন্দন ভাবনার আলোকে নজরুলের নাটক বিচার করা হলে ঔপনিবেশিক নাট্যধারার বাইরে নজরুল যে ভিন্ন নাট্যধারার পথিকৃৎ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নজরুলের নাটক বিচার করতে হবে হাজার বছরের নৃত্য-গীত ও কাব্যময় বাংলা নাট্যের প্রেক্ষাপটে। উনিশ শতকের ইওরোপীয় ক্লিশে নাট্যধারার অনুকৃতির বদলে নজরুলের নাটকের গীতবহুলতা তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলা নাট্যধারায় কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরসূরি।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ