ভালোবাসার মালা পরেই চলে গেলেন তিনি

নতুন কোনো গানে আর শোনা যাবে না তার মধুর কন্ঠস্বর। ৬ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অন্য এক ঠিকানায়। যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ দিন লড়াই করে অবশেষে হার মেনেছেন প্লেব্যাক সম্রাট। বিদায় জানালেন দেশ, দেশের মানুষ আর সঙ্গীতকে। তার গানের মতোই তিনি যেন অগনিত ভক্ত-শ্রোতাদের কানে কানে বার বার বলে গেলেন-‘ও আমি চলতে পথে দুদিন থামিলাম,ভালোবাসার মালা খানি গলে পরিলাম। ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে -রইবনা আর বেশি দিন তোদের মাজারে।সত্যিইতো, কোটি কোটি ভক্তের অগনিত ভালোবাসার মালা গলায় পরেই তিনি চলেন গেলেন অন্তিম যাত্রায়।
সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে বলা হয় বাংলাদেশের প্লেব্যাক সম্রাট। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি ১৫ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন সিনেমায়।
চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের অভিষেক হয় ১৯৭৭ সালের ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমা দিয়ে। এতে আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ শীর্ষক একটি গান গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর তিনি বাদল রহমান পরিচালিত ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ সিনেমায় ‘ধুম ধাড়াক্কা’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দেন।
তবে এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা আসে ১৯৭৯ সালে, সে বছর এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতীজ্ঞা’ সিনেমায় তার কণ্ঠে ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বৃষ্টিধারার মতো গান করে গেছেন এন্ড্রু কিশোর।
তার গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙের ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি বন্ধু আমার চিরসুখে থাকো’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ও সাথী রে যেও না কখনো দূরে’, ‘কী যাদু করেছো বলোনা’, ‘প্রতিদিন ভোর হয়’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘এতো প্রেম ছিল’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’, ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ’সহ আরও অসংখ্য গান।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এন্ড্রু কিশোর জিতেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে আটবার শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার ও দুইবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অন্যতম।
গায়ক এন্ড্রু কিশোর ছিলেন একজন নিরহংকারী মানুষ। জীবন যাপনেও উচ্চবিলাসিতা ছিলো না তার। শিল্পীর বন্ধু-স্বজন ও কাছের মানুষেরা সেই কথাই বলছেন। অনেকে বলছেন, দেশকে ভালোবাসতেন তিনি। বাংলার পথঘাট মাটি বায়ু আর কোলাহলকে তিনি জীবনের আনন্দ ঘ্রাণ হিসেবে মেখে নিয়েছিলেন।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থেকেও উতলা ছিলেন কবে দেশে ফিরে আসবেন সে নিয়ে। মানুষ নাকি মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে তার চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। হয়তো তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই চিকিৎসককে ডেকে বলেছিলেন, ‘আমাকে দেশে পাঠিয়ে দাও। দেশের মাটিতে গিয়ে আপনজনদের কাছে মরতে চাই আমি।’ ফিরেও এসেছিলেন। অল্প ক’টা দিন ঢাকায় কাটিয়ে একেবারে ফিরে গেলেন সেখানেই, যেখান থেকে তার আবির্ভাব, যেখানে তার শেকড় গেঁথে আছে।
অথচ এই এন্ড্রু কিশোর একটু লোভ করলেই নিতে পারতেন দারুণ এক সুযোগ, যা তাকে মুম্বাইয়ের সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠিত করে দিত। বলিউডের একজন জনপ্রিয় গায়ক হিসেবেই হয়তো আজ উচ্চারিত হতো তার নাম। এদেশের মানুষ আফসোস মাখা অহংকার নিয়ে বলত, ‘ভারতের গায়ক এন্ড্রু কিশোর তো আমাদের বাংলাদেশেরই মানুষ। তিনি রাজশাহীতে জন্মেছিলেন।’ যেমনটা বলি আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্নিক ঘটক, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জিদের বেলায়।
বলিউডের মিউজিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ আরডি বর্মণ নিজে এন্ড্রু কিশোরকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে স্থায়ী হওয়ার। বলেছিলেন, নিয়মিত থাকলে ক্যারিয়ার গড়ে দেবেন এন্ড্রু কিশোরের। তার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন শচীন দেব বর্মণের ছেলে রাহুল দেব বর্মণ। সংক্ষেপে যাকে আরডি বর্মণ বলে ডাকা হয়। অনেকে আবার পঞ্চমদা বলেও ডাকেন তাকে। এন্ড্রু কিশোর আরডি বর্মণের সেই প্রস্তাব বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের দেশের সংগীতেই ভালো থাকবেন বলে জবাব দিয়েছিলেন।
বেশ কয়েক বছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে এন্ড্রু কিশোর নিজেই জানিয়েছিলেন সেই গল্প। সেখানে এন্ড্রু বলেন, ‘ভাবতে ভালো লাগে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে আরডি বর্মণের সুরে হিন্দি গান গেয়েছি। বাংলাতেও গেয়েছি। যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘শত্রু’ যেটি বাংলায় নাম ছিলো ‘বিরোধ’, সেখানে মোট তিনটি গান আমি গেয়েছিলাম। দুটি হিন্দিতে এবং বাংলা ছবির জন্য একটি বাংলায়। ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ নামের গানটা হিন্দিতে গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, যার বাংলা ভার্সনটা আমি গেয়েছিলাম। বিখ্যাত গীতিকার মাজরু সুলতানপুরির লেখা ‘সুরেজ চান্দা’, ‘মে তেরি বিসমিল হু’ এই হিন্দি গান দুটি গাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ‘মুখে বলো তুমি হ্যাঁ, ‘এর টুপি ওর মাথায়’ এবং ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা’ গানগুলো পঞ্চমদার সুরে গেয়েছিলাম। এটা সেই ১৯৮৫ সালের কথা। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাজেশ খান্না ও শাবানা।
গান করতে গিয়ে পঞ্চমদার স্নেহ পেয়েছিলাম আমি। মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাসায় তাকে প্রথম দেখি। তিনি আমাকে কখনোই নাম ধরে ডাকেননি। আদর করে ‘ঢাকাইয়া’ বলতেন। সেই সময় পঞ্চমদার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। এত কাছের হয়ে গেলাম যে, আশা ভোঁসলের সঙ্গে তার কীভাবে প্রেম হলো, সেসব গল্পও করতেন আমার সঙ্গে। তার পর দেশে চলে এলাম। পরে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার প্রায় এক-দেড় মাস পর আবার মুম্বাই গেলাম এবং স্টুডিওতে ভয়েস দেওয়া শুরু করলাম।
কাজ শেষে যখন ফেরার আগে পঞ্চমদার কাছে বিদায় নিতে গেলাম তিনি বললেন, ‘ঢাকাইয়া তুই ভালো থাকিস।’
প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের প্রস্থান শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে সংগীতের অনুরাগীদের। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নানা বয়স-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক প্রকাশ করছেন।
শিল্পীর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৫ জুলাই সমাহিত করা হবে তাকে। কারণ তার দুই সন্তান সপ্তক ও সংজ্ঞা এখন অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছেন। তারা দেশে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ