কুয়েত সিআইডির রিমান্ডে বাংলাদেশের সাংসদ পাপুল

কুয়েত সিটির মুশরিফ এলাকার বাসা থেকে গত শনিবার রাতে লক্ষীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলকে আটক করে তাদের দপ্তরে নিয়ে যায় সিআইডি।কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যের নামে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটর।কুয়েতের সিআইডির (ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) আবেদনের প্রেক্ষিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
সিআইডি জানতে পেরেছে, কুয়েতে পাপুলের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যের নামে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
সোমবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে,মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের সঙ্গে যুক্ততার অভিযোগে বাংলাদেশের সাংসদকে আটকের বিষয়টি কুয়েতের সিআইডির কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
একইদিন কুয়েত থেকে প্রকাশিত আরব টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির সিআইডির কর্মকর্তারা পাঁচ বাংলাদেশিকে জেরা করে জানতে পেরেছে তাদের প্রত্যেকেই কুয়েত যেতে সাংসদকে তিন হাজার দিনার করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও প্রতি বছর তারা ভিসা নবায়নের জন্য সাংসদকে বাড়তি টাকা দিয়েছেন। তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সাংসদ কাজী শহিদের বিরুদ্ধে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগ এনেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের সাংসদের গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করলেও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানতে পারেনি সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস।জানতে চাইলে কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম মুঠোফোনে গণমাধ্যমকে বলেন, সাংসদ কাজী শহিদকে আটকের খবর এখানকার গণমাধ্যমে জানার পর এ নিয়ে জানতে রোববার কুয়েতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখি। এখন পর্যন্ত আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানতে পারিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাংসদ কাজী শহিদ গত মার্চে কুয়েত সফরে যান।তবে ব্যক্তিগত ভাবে যাওয়ায় তিনি সবুজ পাসপোর্টে নিয়ে কুয়েত গেছেন। সাধারণত মন্ত্রী, সাংসদ, কূটনীতিকেরা লাল পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ সফর করেন।যা তাদের কূটনৈতিক প্রাধিকার দিয়ে থাকে বিদেশের মাটিতে।
সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক পৃথিবীর যেকোনো দেশে সমস্যায় পড়লে তাকে আমরা কনস্যুলার সার্ভিস (দেশের নাগরিক হিসেবে সব ধরনের সেবা) দিয়ে থাকি।‘উনিও (কাজী পাপুল) এ দেশের নাগরিক। তিনি চাইলে আমরা এই সুবিধা দেব। তবে এর আগ তিনি আটক হয়েছেন কি-না, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হবে। আমাদের দূতাবাস এটা নিয়ে কাজ করছে,’ বলেন ড. মোমেন।
ড. মোমেন বলেন, “কুয়েতে আমাদের রাষ্ট্রদূত আমাকে জানিয়েছেন যে, ‘তিনি শুনেছেন মানিলন্ডারিং এবং মানবপাচারের অপরাধে আমাদের একজন সংসদ সদস্য শহীদ ইসলামকে কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের লোকেরা অ্যারেস্ট করেছেন।’তবে কাতার কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে অফিশিয়ালি আমাদেরকে কিছু জানায়নি। তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছি না।”
তিনি বলেন, ‘কুয়েতের দুর্ঘটনাটি (এমপি পাপুলের আটক ) এমন সময়ে হয়েছে যখন লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ জন বাংলাদেশি নির্মমভাবে নিহত হওয়ায় সারা পৃথিবী পাচারকারীদের ওপর খুব অসন্তুষ্ট।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের অপরাধীদের শাস্তি হয় না বলে পাচার বন্ধ হচ্ছে না।। আমরা চাই পাচারকারীরা শাস্তি পাক। কঠিন শাস্তি হলেই কেবল পাচার বন্ধ হওয়া সম্ভব।’
এর আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতের আরবি দৈনিক আল কাবাস ও আরব টাইমস বাংলাদেশের এক সাংসদসহ তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কুয়েতের সিআইডির বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছিল, স্বতন্ত্র এই সাংসদসহ তিনজনের ওই চক্র অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে। কুয়েতের গণমাধ্যমগুলো অভিযুক্ত সাংসদের নাম প্রচার করেনি। তবে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভিযুক্ত সাংসদের নাম কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুল। তিনি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ।
কুয়েতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘মানব ও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, এমন কয়েক শ ব্যক্তির তালিকা করেছে কুয়েত সরকার। সেই তালিকা ধরেই সম্প্রতি বিতর্কিত শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির গোয়েন্দা বিভাগ। সেই অভিযানেই গ্রেপ্তার হন এমপি পাপুল।
জানা গেছে, পাপুল ১৯৯২ সালে শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যান বড় ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরে। আজ দেশে দুটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি । কুয়েতেও রয়েছে তার একাধিক প্রতিষ্ঠান। আলিশান বাড়ি-গাড়িসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি। পাপুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি শুধু বিত্তে থেমে থাকেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থেকেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা আকস্মিকভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনই হয়েছেন সংসদ সদস্য। নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। আর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম কুমিল্লা থেকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হয়েছেন।
পাপুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধানও চলছে। দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের তত্ত্বাবধানে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। দুদকে আসা অভিযোগপত্রে এমপি কাজী শহিদের বিরুদ্ধে কমিশন খেয়ে ব্যাংকঋণ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা পাপুল ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট শরিক জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেয়। আর পাপুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গাঢাকা দেন। সে সময় অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। পরে ভোটে জিতে এমপি হয়ে যান পাপুল। পরবর্তী সময়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদ। সেলিনা কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ