কালজয়ী গানের স্রষ্টা

রাজু আনোয়ার: সত্তরের দশক ছিলো বাংলা সিনেমার এক সোনালী যুগ । সেই যুগে সমৃদ্ধ হয়েছিল বাংলা গানের ভান্ডার । সে সময়কার বেশ কিছু বাংলা গান আজও শ্রোতার হৃদয়ে শিহরন জাগায় । সেই সোনালী যুগের স্বর্ণালী গান যারা রচনা করে গেছেন তাদের অন্যতম একজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার । বাংলার গানের কালজয়ী গানের স্রষ্টা মাজহারুল আনোয়ার একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার ।বিবিসি বাংলা তৈরিকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান । ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি । তাঁর লিখা বহু কালজয়ী গান আমাদের চলচ্চিত্রের গানের ভাণ্ডারের আলাদা এক সম্পদ হয়ে আছে।
১৯৪৩ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার । ১৯৬২-৬৩ সালে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় প্রথম “বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে” গানটি লিখেন তিনি। যার সুর করেছিলেন নাজমূল হুদা বাচ্চু ও শিল্পী ছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্থানে গান লিখা শুরু করেন । সেইসময়ে গানপ্রতি ৫০ টাকা পেতেন যা দিয়ে তাঁর পেশাদার গীতিকার জীবন শুরু। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন । সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি দিয়ে চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ।প্রয়াত আঞ্জুমান আরা বেগম ও বশির আহমেদের কণ্ঠের সেরাগানগুলোর তালিকায় আজো শীর্ষে আছে এই গান ।
রুনা লায়লার গাওয়া চলচ্চিত্রের প্রথম গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে কি হবে ‘’ গানটিও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লিখা । তাঁর লিখা ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রেরণাদায়ক গান হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল । আঞ্জুমান আরা বেগম , রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন,এন্দ্রু কিশোর, সৈয়দ আব্দুল হাদি সহ এমন কোন খ্যাতিমান শিল্পী নেই যে যার কণ্ঠে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লিখা গান নেই । জহিরুল হকের ‘সারেন্ডার’ ছবিতে জসিমের লিপে ‘সবাই তো ভালোবাসা চায় ‘ গানটি দিয়ে তো সারেন্ডার ও জসিমকে দর্শকদের হৃদয়ে ঠাই করে দিয়েছেন এবং যে গানটির জন্য সুরকার আলম খান ও শিল্পী অ্যান্ড্রো কিশোর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ।
জীবন্ত কিংবদন্তী গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২১ হাজার গানের স্রস্টা ও আমাদের বাংলা গানের সর্বকালের সেরা গীতিকারদের একজন ।স্বনামখ্যাতি এই গীতিকবির লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখকরার মতো আরও কয়েকটি গান হলো – আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার,একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল, একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হল, গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে, যার ছায়া পড়েছে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, গীতিময় সেইদিন চিরদিন, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, দয়াল কি সুখ তুমি পাও, চলে আমার সাইকেল হাওয়ার , প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয় প্রভৃতি ।
তিনি একজন সফল কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকও । গাজী মাজহারুল আনোয়ারের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘দেশ চিত্রকথা’।দেশ চিত্রকথা থেকে গাজী মাজহারুল আনোয়ার ৪২ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার সবগুলোতে তিনি পরিচালক হিসেবে ছিলেন না । গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবিগুলো হলো –শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, শ্রদ্ধা, ক্ষুধা, স্নেহ, তপস্যা, উল্কা, আম্মা, পরাধীন,আর্তনাদ,পাষাণের প্রেম, এই যে দুনিয়া, । পরিচালনা করেননি কিন্তু ছবি প্রযোজনা করেছেন সেই ছবিগুলো হলো সমাধান,অগ্নিশিখা, অনুরোধ, জিঞ্জির, আনারকলি, নানটু ঘোটক, চোর, বিচারপতি, সন্ধি, স্বাক্ষর । অন্যর প্রযোজিত কিন্তু গাজীর পরিচালনার ছবিগুলো হলো ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘জীবনের গল্প’, অনন্ত জলিল প্রযোজিত ‘হৃদয় ভাঙা ঢেউ’।
তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, ৩ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য, সেন্সরবোর্ডের সদস্য, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৯২ সালে ‘উচিৎ শিক্ষা’, ১৯৯৬ সালে ‘অজান্তে’ ,২০০১ সালে ‘চুড়িওয়ালা’, ২০০২ সালে ‘লাল দরিয়া’, ২০০৩ সালে ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’ চলচ্চিত্রগুলোর জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে সর্বমোট ৫ বার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন তিনি ।গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন (১৯৭২ সালে) ।একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, জিয়া স্বর্ণপদক , এস এম সুলতান স্মৃতি পদক, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০ ।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু, তোমার কালো ফ্রেমের চশমাটা আমায় দাও, আমি চোখে দিয়ে দেখব, তুমি কেমন করে দেশটাকে এতো ভালোবাস’ গানের কথা লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার । কুমার বিশ্বজিতের কন্ঠে এই গানের সংগীতায়োজন করেছেন মানাম আহমেদ, সুর করেছেন তরুণ গায়ক ও সংগীত পরিচালক কিশোর।
এই গানের গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু যখন ক্ষমতায় এলেন, অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান । আমি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা । যাবই যেহেতু, মন চাইল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান লিখে নিয়ে যাই। তিনি আমাকে এমনিতেই আদর করতেন। যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, মাথার চুল ধরে আদর করে বলতেন, এই তুই নড়বি–টড়বি না। বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা থেকে “হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু, তোমার কালো ফ্রেমের চশমাটা আমায় দাও’ কবিতাটি লিখে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর খুব পছন্দ হলো । শুনেছিলাম, এটি তিনি বাঁধাই করে ঘরের দেয়ালে রেখেছিলেন । মাস ছয়েক আগে একদিন বিশ্বজিৎ এই কবিতার খোঁজ পায় । তারপর এটিকে গানে রূপান্তর করার অনুমতি চায়। আমি বলেছি, অনুমতির কিছু তো নাই, গান বানাবে, এটা তো খুবই আনন্দের খবর। এরপর প্রাথমিকভাবে বিশ্বজিৎ গানটি বানিয়ে আমাকে শোনায়।
চিরকাল বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা মেধাবী মানুষ গাজী মাজহারুল আনোয়ার আজ আমাদের মিডিয়ায় বড় অবহেলিত । জন্মদিনে দেশের এই বরেণ্য – গুণী মানুষটিকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা । তিনি আমাদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াক আরো অনেক অনেক দিন । বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল ।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ৭৭তম জন্মদিনে বড় পরিসরে বিশেষ কোনো আয়োজন না থাকলেও তার সুযোগ্য কন্যা দিঠি আনোয়ার বাবাকে জন্মদিনে একটি গান উপহার দিয়েছেন । গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা সিনেমার প্রথম গান ‘আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল’ গানটি নতুন করে গেয়েছেন দিঠি আনোয়ার। নতুন করে গানটির সংগীতায়োজন করেছেন এ প্রজন্মের মেধাবী সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক ইউসুফ আহমেদ খান।
বাবার জন্মদিনে বাবারই লেখা গান নতুন করে গেয়ে জন্মদিনে প্রকাশ করা প্রসঙ্গে দিঠি আনোয়ার বলেন, ‘সত্যি বলতে কী আব্বুর জন্মদিনটা সবসময়ই আমার কাছে বিশেষ কিছু। তাই এবার ভাবলাম, আব্বুর সিনেমায় লেখা প্রথম গানটা নতুন করে গেয়ে আব্বুকে উপহার দিই। সেই ভাবনা থেকে গানটি করা। গানটি করতে আমাকে ভীষণ সহযোগিতা করেছে আমারই আদরের ছোট ভাই ইউসুফ আহমেদ খান। খুব চমৎকার পুনঃসংগীতায়োজন করেছে ইউসুফ। আর আমি শ্রদ্ধেয় আঞ্জুমান আরা আন্টির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমার মতো করেই গেয়েছি। আশা করছি শ্রোতা-দর্শকদের গানটি ভালো লাগবে।’
গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘দিঠি তার মতো করেই গানটি গাওয়ার চেষ্টা করেছে। গানে তার নিজস্বতা রেখেই গানটি গেয়েছে। শ্রোতা-দর্শকদের ভালো লাগবে আশা করছি।’
আলোআভানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরএ